প্রকাশিত: Fri, Dec 8, 2023 9:58 PM
আপডেট: Mon, Jun 23, 2025 8:22 PM

পাঠ্যপুস্তক ও রাজনীতি

শিশির ভট্টাচার্য্য : পাঠ্যপুস্তকের সমালোচনার পেছনে বাংলাদেশের রাজনীতি রীতিমতো ক্রিয়াশীল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রায় সবগুলো আসন পেলেও ভোট নাকি শতকরা চল্লিশ ভাগের বেশি পায়নি। এখনও বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের সমর্থক ব্যক্তি ও পরিবার মোট জনসংখ্যার ওই চল্লিশ ভাগের বেশি নয়। সত্তরের দশক থেকেই পূর্ববঙ্গের মানুষ দুই পৃথক শিবিরে ভাগ হয়ে গেছে: ১. বাঙালিবাদী এবং ২. বাঙালিবিরোধী, কিংবা ১. আওয়ামী লীগপন্থী এবং ২. আওয়ামী লীগবিরোধী। প্রথমটিকে আমরা বলতে পরি, ‘এ’ পক্ষ এবং অন্যটিকে বলতে পারি ‘বি’ পক্ষ (বিপক্ষ?)। এ এবং বি-কে আপনারা ইংরেজি বর্ণও বিবেচনা করতে পারেন। 

এ পক্ষের সবাই বাঙালিবাদী নয়, কিন্তু বি-পক্ষের বেশির ভাগ কমবেশি বাঙালিবিরোধী এবং অবশ্যই আওয়ামী লীগবিরোধী। আওয়ামী লীগবিরোধী ব্যক্তির সংখ্যা মোট জনসংখ্যার শতকরা ত্রিশ ভাগ ধরা নেওয়াই যায়। ধরা যাক, বাকি ত্রিশ ভাগ ভাসমান। তারা কখনও এ পক্ষে, কখনও বি পক্ষে যোগ দিলে ক্ষমতার পালাবদল ঘটার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। গত দেড় দশক ধরে এ পক্ষ ক্ষমতায় আছে। রাসেল বলেছেন, সরকার মাত্রেই তার নীতি অনুসারে শিক্ষাকে পরিবর্তন করতে চায়। হিটলারের নাৎসি সরকারের পাঠ্যপুস্তক আর নাৎসিমুক্ত জার্মানির পাঠ্যপুস্তকের মধ্যে পার্থক্য থাকবেই। বর্তমান শিক্ষাক্রমের পদার্থবিজ্ঞান বইটির পুস্তানীতে ১৯৭১ সালের পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে নিহত শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ছবি দিয়ে তাদের মৃত্যুর কারণ বর্ণনা করা হয়েছে। এরপর আছে ১৪ ডিসেম্বর বা শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালনের তারিখের তাৎপর্য। এই পুস্তকটিই বি-পক্ষের সমর্থকদের গায়ে জ্বালা ধরানোর মতো। 

পদার্থবিজ্ঞানের বইতে পদার্থবিজ্ঞানের মহারথীদের ছবি রয়েছে, যাদের অনেকে অমুসলিম এবং নারী। এটাও ওই দলের কারও কারও গায়ে জ্বালা ধরানোর মতো। গতি বোঝানোর জন্য দোলনার ছবি আছে এবং দোলনায় দুলছে চুলখোলা, (বি-পক্ষের দৃষ্টিতে) বেপর্দা একটি কিশোরী। বলপ্রয়োগের উদাহরণে দেওয়া হয়েছে সাউথ এশিয়া গেমসে ভারোত্তলনে স্বর্ণবিজয়ী মাবিয়া আখতার সীমান্ত। বলপ্রয়োগ করছেন, কোনো পুরুষ নয়, এক বেপর্দা নারী। মহাকাশ স্টেশনের ছবিতে আছে দুই নারী-পুরুষ, বেপর্দা, বেগানা। পদার্থের অবস্থা ও চাপ অধ্যায়ে রয়েছে এভারেস্টজয়ী বেপর্দা নারী নিশাত মজুমদার। হাইড্রলিক প্রেসে চাপ দিয়ে মোটাসোটা এক পুরুষকে উপরে তুলে ফেলছে ক্ষীণকায়া আরেক বেপর্দা নারী। পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রতিবিম্বের উদাহরণেও শাড়িপরা নারী কিংবা বয়কাট চুলের নারী। বিপরীত রঙে আঁকা ছবিতে মুক্তিযোদ্ধার প্রতিকৃতি, টেলিভিশনের পর্দায় চুলখোলা বেপর্দা মহিলা... বি-পক্ষের বিরক্তির কারণ হতে পারে এসব ছবি। 

বাংলা সাহিত্য বইয়ের পুস্তানিতে প্রয়াত অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম এবং এ দলের আমলা-কবির উপস্থিতিতে সপরিবারে প্রধানমন্ত্রীর মুজিববর্ষের ক্ষণগণনার ছবি। এগুলো অবশ্যই এ দলের বিজ্ঞাপন, যা বি দলের পছন্দ হবার কোনোই কারণ নেই। বাংলা সাহিত্যের বইতে টেক্সট এবং প্রশ্নে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ প্রতিফলিত হয়েছে বারবার। বি দলের লোকজনের এগুলোও পছন্দ হবার কথা নয়। সব মিলিয়ে বর্তমান পাঠ্যবই অপছন্দ করার পেছনে বাংলাদেশের যুগান্তরের ও সাম্প্রতিক রাজনীতি একেবারেই ক্রিয়াশীল নেইÑ এ কথা বলা যাবে না।

‘ইংলিশ ফর টুডে’ বইটা আমার নিজেরও বিন্দুমাত্র পছন্দ হয়নি, যদিও সেটা রাজনৈতিক কারণে নয়। সত্তরের দশকে ইংরেজি আমরা এমন সব লোকের লেখা পড়ে শিখেছিলাম, যাঁরা ছিলেন ইংরেজি ভাষার লেখক। আমরা প্রকৃত ইংরেজি সাহিত্য পড়েছি নবম-দশক শ্রেণিতে। ‘ওয়াইজ ম্যান অফ দি ওল্ড’, ‘মেকিং এ ফিল্ম’ ইত্যাদি প্রবন্ধ পড়ে ইংরেজি শেখার পাশাপাশি আমাদের মনোজগতও গঠিত হয়েছিল। অনুবাদ সাহিত্যও পড়েছি, টলস্টয়ের গল্প ‘থ্রি কোয়েশশন’। বাঙালি লেখকের দুর্বল ইংরেজি রচনা পড়তে বাধ্য হবার মতো দুর্ভাগ্য আমাদের প্রজন্মের অন্তত হয়নি। ভাষাবিজ্ঞানী হিসাবে আমি  মনে করি, এ ধরনের ইংরেজি শেখার বই শিক্ষার্থীদের ইংরেজি ভাষাজ্ঞান ও বিশ্ববীক্ষার সাড়ে বারোটা বাজাবে। লেখক: ভাষাবিজ্ঞানী। ফেসবুক থেকে